

গুরু পূর্ণিমার মাহাত্ম্য, শান্তি ও ধনদৌলতের জন্য করণীয়
গুরু পূর্ণিমা (Guru Purnima) ভারতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক নিদারুন উদাহরণ। গুরুর কাছে আমাদের চাওয়া পাওয়ার শেষ নেই। আর এই দিনে গুরু ভক্তি ..
বৈদিক ইতিহাস অনুসারে, এই দিনই ‘মহাভারত’ রচয়িতা মহির্ষি বেদব্যাস জন্মগ্রহণ করেছিলেন মুণি পরাশর ও মাতা সত্যবতীর ঘরে। ঠিক সেই কারণেই এই দিনটিকে ‘ব্যাস পূর্ণিমা’-ও বলা হয়ে থাকে। গুরু পূর্ণিমা (Guru Purnima) ভারতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক নিদারুন উদাহরণ। গুরুর কাছে আমাদের চাওয়া পাওয়ার শেষ নেই। আর এই দিনে গুরু ভক্তি ও গুরু জ্ঞানের মাহাত্ম্য অত্যধিক।
ভারতে আজও গুরু, শিষ্য পরম্পরা অব্যাহত। গুরু বিনা তাত্ত্বিক অথবা কার্মিক সাধনায় সিদ্ধিলাভ একপ্রকার অসম্ভব। ঐশর্য্য ও যশ লাভের আশায় মনুষ্য সমাজ এই দিনটিতে বিশেষ উপাচার ও পূজা অর্চনা করে থাকে। নেপালে এই দিনটিতে শিক্ষক দিবস পালন করা হয়। 2020 সালের গুরু পূর্ণিমার তিথি ৪ঠা জুলাই বেলা ১১.৩৩ মিনিটে শুরু হয়ে পরের দিন সকাল ১০.১৩ পর্যন্ত থাকবে।


‘গুরু’ শব্দটি মানব জাতির কাছে এক প্রাপ্তির অনুভূতি। জন্ম থেকেই আমরা পিতা ও মাতাকে গুরু বলে মেনে থাকি। এরপর শিক্ষাজীবনে আমরা শিক্ষাগুরুর সান্নিধ্য পাই। এটাই প্রকৃতির নিরন্তর স্মৃতি। কর্মজীবনে গুরুপ্রাপ্তি ঘটলে কর্ম সুখের হয়। গুরু বিনা জ্ঞান সম্ভব নয়। একজীবনে একাধিক গুরুর সান্নিধ্য স্থান, কাল, ও পাত্র ভেদে হয়ে থাকে । জ্ঞান ও পার্থিব বিষয়ও আমরা পেয়ে থাকি গুরুর কাছ থেকে। বিজ্ঞান সম্মতভাবে, অভ্যাসগত প্রতিবর্ত ক্রিয়া পার্থিব জ্ঞান ছাড়া সম্ভবই নয়। আর এখানে গুরুর প্রবেশ।
[ আরো পড়ুন ] বিপত্তারিণী পুজো – দেবী সঙ্কটনাশিনীর রূপ
‘গুরু‘ একটি প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃত শব্দ। এই শব্দটি ‘গু’ এবং ‘রু’ এই দুটি শব্দ দ্বারা গঠিত । ‘গু’ শব্দের অর্থ “অন্ধকার” / “অজ্ঞতা” এবং ‘রু’ শব্দের অর্থ “যা অন্ধকার দূরীকরণ করে“। অর্থ্যাৎ, ‘গুরু’ শব্দটি দ্বারা এমন এক মহা ব্যক্তিকে নির্দেশ করে, যিনি অন্ধকার দূরীভূত করেন।
ধর্মগুরু সদগুরুর কথায়:
গরু পূর্ণিমা একটি তিথি, এই পূর্ণিমাকে আষাঢ়ি পূর্ণিমাও বলা হয়ে থাকে। এই দিনটিতে গুরুকে মনে করার এবং তার আশীর্বাদ গ্রহণের দিন। প্রখ্যাত ভারতীয় ধর্মগুরু সদগুরুর কথায়, “প্রথম গুরুর জন্মের দিন হল গুরু পূর্ণিমা। যোগের সংস্কৃতিতে, শিবকে ভগবান মানা হয় না, তাকে আদি-যোগী বলে গণ্য করা হয়। সর্বপ্রথম যোগী। যেই দিন তিনি নিজেকে এক গুরু হিসেবে রূপান্তরিত করলেন, আদি-যোগীতে রূপান্তরিত করলেন, সেই পূর্ণিমার দিনটিকে গুরু পূর্ণিমা হিসেবে উদযাপন করা হয়।”
[ আরো পড়ুন ] অম্বুবাচীর ব্রতের মাঝে প্রাচীন পবিত্র ধর্মীয় ভাবাবেগ
সদগুরু আরও বলেন, “১৫০০০ বছর আগে, বছরের ঠিক এমন সময়ে, তিনি নজর ফেরালেন তার সাত শিষ্যের ওপর – যাদের আমরা আজ সপ্ত-ঋষি বলে জানি। চুরাশি বছর ধরে তারা নিজেদের তৈরি করছিলেন। তারপর যখন পৃথিবীর গতিপথ উত্তর থেকে দক্ষিণমুখি হল, যেটাকে আমরা উত্তরায়ন-দক্ষিণায়ন বলি, সেই দিন আদি-যোগী সপ্তঋষিদের দিকে চেয়ে দেখলেন যে তারা উজ্জ্বল দীপ্তিশীল আধার হয়ে উঠেছে। তখন তিনি তাদের আর উপেক্ষা করতে পারলেন না। মন দিয়ে তাদের নিরীক্ষণ করলেন, এবং তার পরের পূর্ণিমাতে তাদের গুরু হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। দক্ষিণমুখি হয়ে, যোগ-বিজ্ঞানের শিক্ষাপ্রদান শুরু করলেন।”
বৈদিক শাস্ত্রানুযায়ী গুরু প্রণাম মন্ত্র:
“ওঁ অজ্ঞান তিমিরান্ধস্য জ্ঞানাঞ্জন শলাকয়া।
চক্ষুরুন্মিলিত যেন তস্মৈ শ্রী গুরুবে নমঃ ।
অখণ্ডমণ্ডলাকারং ব্যাপ্তং যেন চরাচারম্।
তত্পদং দর্শিতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ॥
গুরু ব্রহ্মা গুরু বিষ্ণু গুরুদেব মহেশ্বর।
গুরুরেব পরমব্রহ্ম তস্মৈ শ্রীগুরুবে নমঃ”
ব্রিটিশ জামানার আগে ভারতে গুরু পূর্ণিমাকে একটি জাতীয় উৎসব হিসাবে গণ্য করা হতো। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে এই দিনটি গভীর শ্রদ্ধার সাথে পালন করতো। কারণ, তখন জ্ঞানই ছিল একমাত্র পূজ্য। আর জ্ঞাণী মানুষের তর্পন ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য দিনটি ধার্য হয়। প্রসঙ্গত: বৈদিক যুগের কোনো গ্রন্থ বা শাস্ত্রে কিন্তু কোনো হিন্দু, মুসলিম বা বৌদ্ধ ধর্মের উল্লেখ নেই, কারণ তখনও এই সমস্ত ধর্মের আবির্ভাব হয়নি। তখন জ্ঞানের মার্গ দাতা মানেই গুরুকে ধরা হতো।


সমস্ত প্রকার জাগতিক কষ্ট ও দুক্ষ থেকে আংশিক মুক্তি পেতে এই দিনের মাহাত্ম্য অত্যধিক। মানসিক অশান্তি, দারিদ্রতা, ব্যাবসায়িক দুশ্চিন্তা ও কু প্রভাব থেকে মন ও শরীরকে রক্ষা করবার জন্য, বৈদিক নানা বিধান প্রচলিত। কথিত আছে ধন, দৌলত ও মানসিক প্রশান্তির জন্য এই দিনে কিছু বিশেষ কর্ম সকলের পালন করা উচিত।
গুরু পূর্ণিমার দিন করণীয় (হিন্দু ধর্ম মতে):
- গুরু পূর্ণিমাতে লক্ষীদেবীর আরাধনা করবার প্রচলন আছে। বিশেষ করে নারকেলের লাড্ডু দিয়ে। নারকেল লক্ষীমাতার পছন্দের আহার।
- এই বিশেষ দিনে বাড়ির মূল ফটকের সামনে লক্ষী দেবীর পদচিহ্ন আঁকার, এবং তার সামনে ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালানোর প্রচলন আছে।
- এই দিনের দানের মাহাত্ম্য অত্যধিক। সাধ্য মতো যেকোনো জিনিস, যার চাহিদা আছে তাকে দান করতে পারেন।
- বৈদিক যুগে চন্দ্রদেবকেই প্রকাশ্য গুরু বলে অভিহীত করা হতো। এই দিন চন্দ্রের খারাপ দোষ বা দশা কাটাবার জন্য জ্যোতিষ শাস্ত্রমতে নানা বিধান আছে। যার মধ্যে অন্যতম হলো, সন্ধ্যায় ধুপ ও দ্বীপ সহকারে চন্দ্রদেবকে জল তর্পন করা ও খোলা স্থানে সমস্ত সাদা ফলের প্রসাদ সামগ্রী প্রদান করা।
- এছাড়াও, একটি নারকেলকে লাল কাপড়ে মুড়ে তার উপর আটা ও সিঁদুরের তিলক কেটে চন্দ্রদেবকে অর্পণ করলে ব্যাবসার সমস্ত বাধার দূরীকরণ হয়।
- এই দিন পশু ও পাখিকে নিজহস্তে আহার করালে ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করে।
- শাস্ত্রমতে, এদিন গঙ্গাস্নানের মাহাত্ম অধিক। সমস্ত পাপ ও কষ্ট মোচনে গঙ্গাস্নানের বিধান আছে।
- গুরু পূর্ণিমাতে, সুগন্ধি ফুল, ফল ও ধুপ দিয়ে পূজা করলে আর্থিক কষ্ট ও দারিদ্রতা থেকে মুক্তি মেলে। তবে এই পূজা পূজারী বা পুরোহিত ছাড়া সম্ভবপর নয়।
- এই দিন সত্ত্যনারায়ণ পূজার প্রচলণ আছে। এই পূজার মাধ্যমে গৃহের ও মনের উপর থেকে সমস্ত প্রকার কু প্রভাবকে মুছে ফেলা যায়।