

অমাবশ্যা তিথিতে কালী পুজো – পূজার বিধি, মন্ত্র ও ইতিহাস
কার্ত্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে, দীপান্বিতা কালীপূজা (Kali Puja) বিশেষ ভাবে পালিত হয়। হিন্দু দেবী মা কালীর অন্য নাম শ্যামা বা আদ্যাশক্তি।
নিজস্ব প্রতিবেদন: হিন্দু ধর্মালম্বীদের কাছে অন্যতম আরাধ্য দেবী মা কালী। তন্ত্র মতে কালী দশমহাবিদ্যার প্রথম দেবী। শাক্তমতে মা কালী, এই বৃহৎ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আদি কারণ। কার্ত্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে, দীপান্বিতা কালীপূজা (Kali Puja) বিশেষ ভাবে পালিত হয়। হিন্দু দেবী মা কালীর অন্য নাম শ্যামা বা আদ্যাশক্তি। শাক্ত ধর্মাবলম্বীরা এই কালীর পূজা করেন। বেদের কোথাও কালীর উল্লেখ পাওয়া যায় না। অর্থাৎ, কালী বৈদিক কোনও দেবী নন। বৈদিক সাহিত্যে ‘কালী’ নামটি প্রথম পাওয়া যায় মুণ্ডক উপনিষদে। এই উপনিষদে অগ্নির সপ্তজিহ্বার দুইটি কালী ও করালীর নাম উল্লেখ আছে। গুণবত দিক থেকে দেবী কালিকা, রজোগুণ দ্বারা সৃষ্টিকর্ত্রী, সত্ত্বগুণ দ্বারা পালনকর্ত্রী ও তমোগুণ দ্বারা সংহারকর্ত্রী।
কালী কালী মহাকালী কালিকে পাপহারীণি।
ধর্মকামপ্রদে দেবী নারায়ণী নমোহস্তুতে।।
এষ সচন্দন বিল্ব-রক্তজবাপুষ্পাঞ্জলী শ্রীমদদক্ষিণাকালিকায়ৈ নমঃ।।
প্রকৃত অর্থে – ‘কালী’
আসলে এই ‘কালী’ শব্দটি, ‘কাল’ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ। এই প্রকৃত অর্থ ‘কৃষ্ণ’ বা ‘ঘোর বর্ণ’। মহাভারতে ‘কালরাত্রি’ বা ‘কালী’ নামে এক দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। যদিও এই ‘কাল’ শব্দের দুটি অর্থ – ‘নির্ধারিত সময়’ ও ‘মৃত্যু’। কিন্তু দেবী প্রসঙ্গে এই শব্দের অর্থ “সময়ের থেকে উচ্চতর“। প্রকৃত অর্থে কাল বা সময়কে কলন বা রচনা করেন যিনি, তিনিই কালী।


-তন্ত্র পুরাণে দেবী কালীর নয়টি রূপ-
দক্ষিণকালিকা, কৃষ্ণকালী, সিদ্ধকালিকা, গুহ্যকালিকা, শ্রীকালিকা, ভদ্রকালী, চামুণ্ডাকালিকা, শ্মশানকালিকা ও মহাকালী।
কালী কালী মহাকালী কালিকে পরমেশ্বরী।
সদানন্দ করে দেবী নারায়ণী নমোহস্তুতে।।
এষ সচন্দন বিল্ব-রক্তজবাপুষ্পাঞ্জলী শ্রীমদদক্ষিণাকালিকায়ৈ নমঃ।।
তন্ত্রসারের বর্ণনা অনুযায়ী দেবী কালী হলেন, করালবদনা, ঘোরা, মুক্তকেশী, চতুর্ভুজা, দক্ষিণা, দিব্যা ও মুণ্ডমালাবিভূষিতা। বামহস্ত-যুগলের অধোহস্তে সদ্যশ্ছিন্ন শির, আর ঊর্ধ্বহস্তে খড়্গ। আবার দক্ষিণের অধোহস্তে অভয়, ঊর্ধ্বহস্তে বর। দেবী মহামেঘের মতো শ্যামবর্ণা ও দিগম্বরী। মায়ের কণ্ঠলগ্ন মুণ্ডমালা থেকে রক্ত প্রবাহিত হয়। আর দুইটি শবশিশু তাঁর কানের অলংকার। তাঁর কেশ দক্ষিণব্যাপী ও আলুলায়িত। তিনি শবরূপ মহাদেবের দেহের উপর সংস্থিতা। নারীশক্তির স্বরূপ দেবী ভগবতী সমাজের অনিষ্টকারী শক্তিকে বিনষ্ট করে সকলকে অন্ধকার থেকে আলোর পথ দেখান।


ঘোরে রাবা চন্ড মুন্ড বধে দেবী প্রচন্ড দোর্দন্ডকারীণি।
সর্বমঙ্গলদায়ীনি দেবী নারায়ণী নমোহস্তুতে।।
এষ সচন্দন বিল্ব-রক্তজবাপুষ্পাঞ্জলী শ্রীমদদক্ষিণাকালিকায়ৈ নমঃ।।
-এই পুজোর বিধি-
এই পুজো শুরু করার আগে লেখনির কালি দোয়াতটি পুজোর আসনে রাখা হয়। অনামিকা দিয়ে লেখনি দোয়াতগুলিতে স্বস্তিক অঙ্কন করতে হয়। স্বস্তিক অঙ্কন শেষে কালী পুজো শুরু করা হয়। সোমরস এই পুজোয় প্রধান ভোগ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মধ্যরাত থেকে ভোর রাত পর্যন্ত এই পুজো সম্পন্ন হয়। সাধারণত ধ্যান, দেবীর আবাহন, পুষ্পাঞ্জলি দ্বারা এই পুজোর বিধি সম্পন্ন হয়। সাধারণত ধ্যান, দেবীর আবাহন, পুষ্পাঞ্জলি দ্বারা এই পুজোর বিধি সম্পন্ন হয়। পাঁচটি লাল জবা ফুল দেবীর চরণে অর্পণ করা হয় একটি বিশেষ মন্ত্রের উচ্চারণে। এরপর চন্দন, পুষ্প, দীপ, ধূপ ও নৈবেদ্য দ্বারা দেবী বন্দনা করা হয়ে থাকে। আলাদা আলাদা মুদ্রা ও মন্ত্র পাঠ ও আরতি, হোম করা হয়ে থাকে।
সর্বমঙ্গল মঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থ সাধিকে ।
উমে ব্রহ্মাণী কৌমারী বিশ্বরূপে প্রসীদ মে।।
ভগবতী ভয়চ্ছেদে কাত্যায়ণী চ কামদে।
কালকৃত কৌশিকি ত্বং হি কাত্যায়ণী নমোহস্তুতে।।
এষ সচন্দন বিল্ব-রক্তজবাপুষ্পাঞ্জলী শ্রীমদদক্ষিণাকালিকায়ৈ নমঃ।।
– কাশীনাথ রচিত শ্যামাসপর্যাবিধি –
১৭৭৭ সালে কাশীনাথ রচিত শ্যামাসপর্যাবিধি গ্রন্থে এই পুজোর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় অষ্টাদশ শতকে প্রজাদের কালীপূজা করতে বাধ্য করেন। সেই থেকে নদিয়ায় কালীপূজা বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে। কালীঘাটের দেবীকালিকা, সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ দিকে গুরুত্ব বাড়ে। কালীঘাটে দেবীর চারটি আঙ্গুল পড়েছিল। কালীঘাটের মূল পুজো আটটি। এখানের কালীপুজোর রাতে দেবীকে লক্ষ্মী রূপে এখানে পুজো করা হয়। দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণী অত্যন্ত বিখ্যাত। গঙ্গাতীরে ১৮৫৫ সালে এই মন্দির তৈরী হয়। রামকৃষ্ণ ছিলেন প্রধান পুরোহিত। ঠনঠনিয়ার সিদ্ধেশ্বরী কালী, আনুমানিক ১৭০৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। তারা মায়ের তারাপীঠ মন্দির প্রতিষ্ঠা হয় ১৮১৮ সালে। সাধক বামাখ্যাপা মন্দিরে এই পূজা করতেন ও শ্মশানে সাধনা করতেন।


প্রচন্ডে পুত্রকে নিত্যং সুপ্রীতে সুরনায়িকে।
কুলচ্যোদে করে চোগ্রে জয়ং দেহী নমোহস্তুতে।।
সৃষ্টি স্থিতি বিনাশানং শক্তিভূতে সনাতনী।
গুনাশ্রয়ে গুনময়ে দেবী নারায়ণী নমোহস্তুতে।
এষ সচন্দন বিল্ব-রক্তজবাপুষ্পাঞ্জলী শ্রীমদদক্ষিণাকালিকায়ৈ নমঃ।।
দশমহাবিদ্যার প্রথম বিদ্যা যে কালী, আসলে তিনিই দক্ষিণাকালী। দক্ষিণাকালীকে শ্যামাকালী বলা হয়। দক্ষিণা দিকের অধিপতি দেবতা ধর্মরাজ যম। দেবী কালিকার ভয়ে তিনি পালিয়েছিলেন বলে তাঁর নাম দক্ষিণাকালী। আবার শবাসনে শায়িত শিবের বুকে দেবীর ডান পা অগ্রভাগে স্থাপন করেছিলেন বলে দেবী দক্ষিণাকালী। বাম পা অগ্রভাগে স্থাপিত হলে দেবী বামাকালী। শ্মশানকালীর রূপ ও আকার ভয়ংকর। দেবীর গায়ের রং কাজলের মতো ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। তিনি বাস করেন শ্মশানে।
– পুরাণ ও তন্ত্রে দেবী কালিকা –
পুরাণ ও তন্ত্রে পাওয়া যায় অসংখ্য দেবী কালিকার কথা। যেমন ধনদাকালী, অষ্টভুজাকালী, আদ্যাকালী, রক্ষাকালী, কামকলাকালী, রটন্তীকালী, ফলহারিণী কালী, ওম্বর কালী, তীর্থকালী, ইন্দির কালী, রমণী কালী, জীবকালী, ঈশানকালী, হংসকালী, প্রজ্ঞাকালী, বশীকরণকালী, সপ্তার্ণকালী, রক্তকালী, সৃষ্টিকালী, সংহারকালী, স্থিতিকালী, স্বকালী, মৃত্যুকালী, যমকালী, পরমার্থকালী, রুদ্রকালী, মহাকালী, কালগ্নিরুদ্রকালী, চণ্ডকালী, মহাভৈরবঘোর কালী প্রভৃতি।
-প্রণাম মন্ত্র-
‘ওঁ ক্রীং ক্রীং হৃং হৃং হিং হিং দক্ষিণে কালীকে ক্রীং ক্রীং ক্রীং হৃং হৃং হ্রীং হ্রীং হ্রীং স্বহা।
ওঁ কালী কালী মহাকালী কালীকে পাপহারিণী
ধর্মার্থমোক্ষদে দেবী নারায়ণী নমোস্তুতে।’
এরপর জপ একশো আটবার করা যায় এই মন্ত্রে-
‘ওঁ ক্রীং কাল্ল্যৈ নমঃ।’